বাইরে অঝোর বৃষ্টি। রাত প্রায় এগারোটা।
মা-পিসি খাবার টেবিলে বসা। পিসি চেয়ারে ঢুলছে। মায়ের কোলে আমি। প্রায় ঘুমন্ত। মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি। খানিকটা দুশ্চিন্তাও।
অবশেষে বাবা বাড়ি ঢুকল।
রূদ্ধশ্বাস প্রশ্ন মায়েরঃ “কী হল?”
মাথা নীচু, অনেকটা বিধ্বস্ত বাবাঃ “আর কি?”
এরপর নিঃশব্দে নৈশভোজ। হতাশা-দুঃখের পাট সেদিনই শেষ। পরদিন থেকেই জানি বাবা লেগে যাবে আবার আগামী ভোটের জন্যে জান লড়াতে। মা আবার মেতে উঠবে বাবাকে প্রশ্রয়-মাখানো বারণ করায়। আমিও আবার স্কুলফেরত বাসের বন্ধুদের হইচইতে উঁকি মেরে দেখব ভিড় রাস্তার কোণে লাল ঝান্ডার তলায় দাঁড়িয়ে বাবাকে। বাবা তখন গাইছে। ওরা ভয় পেয়েছে রোবসন।
আসামে থাকাকালীন আমাদের পরিবার যে রাজনৈতিক দলের সহমর্মী, সেই দলটি কোনদিনই ক্ষমতায় আসেননি বিপুলভাবে হাতে গোনা কয়েকবারের চমৎকারী ঘটনা ছাড়া। তবে থেকেই শুনে আসছি আমাদের রাজনীতিতে ব্যক্তির আগে আসে আদর্শ, আমি-র আগে আসবে তুমি। কিন্ত আমার কেমন যেন সব ঘেঁটে যায়।
এখন থাকি কলকাতায়। চারিদিক আদর্শে ছয়লাপ হয়ে থাকার কথা। কোথাও খুঁজে পাইনা সেই লোকটাকে যে আমার মায়ের ক্লান্ত, হতাশ, বিরক্ত মুখের হাসি হয়ে আসবে। বাবা যখন আজও গায় “আমি শ্রান্ত যে…” কে আছে আলতো করে কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলবার “…তবু হাল ধরো!”
বাউল সাধকেরা জীবন উজাড় করেন শুনেছি অতৃপ্তির সাধন করে। রবি শঙ্করের সেতারে নিষাদ রিনরিন করে ওঠে ষড়জে পৌঁছানোর আর্তিতে। কিন্ত যে কৃষকের তরে চির আঁধার, যে শিশুর মেলেনি দুধ, তার আবার কীসের সাধন? সে আবার কীসের বাউল?
গোটা পৃথিবী মগ্ন দোলখেলায়। আর একজন যুদ্ধফেরত সৈনিক ঘরে ফিরছে। না পাওয়ার রঙের বুলেটটা বোধহয় পড়ে গেছে কোথাও রাস্তায়। তখনও গভীর রাত। তার ঘরেও অপেক্ষা করছে খানিক তাচ্ছিল্য, বিরক্তি। একবুক হতাশা। কানের কাছে একটা শব্দ। নিশির ডাক। রাতের ডাক। ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে অক্ষরগুলি। শুনতে পায় স্পষ্ট-
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া।
কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া।
অবনী, বাড়ি আছ?
এই জন্যই লাল ঝাণ্ডা । যারা একবার দীক্ষিত হয়েছে, তার নিস্তার নেই বিলীন হবার আগে ।
LikeLike