একজন প্রয়োজনীয় ব্যক্তি ও কিছু স্মৃতিচারণ

(আনন্দময়ী ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ, প্রথম প্রকাশিত দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে)

সময়ের সাথে সাথে চোখের সামনে বেশ কিছু জিনিসকে অবসোলিট হয়ে যেতে দেখলাম, দেখছি। অবসোলিট মানে যার প্রয়োজন হারিয়েছে বর্তমান সময়। ঠিক যেভাবে এখন পকেট থেকে টাকার বদলে মোবাইলে ভেসে ওঠে ফোনপে বা জিপে, ঠিক যেভাবে সময়ের সাথে সাথে আমরা ভুলেছি ফ্লপি ডিস্ক, অডিও ক্যাসেট থেকে গল্পের বই, সবকিছু। সেভাবেই নিয়ম মেনে সপ্তাহে একদিন গুরুর কাছে গান শিখতে যাওয়ার চলটাও আস্তে আস্তে অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। বদলে স্থান পাচ্ছে কানে হেডফোন গুঁজে কয়েক মিনিটে গান তুলে নেওয়া, ভিডিও দেখে নাচ শিখে নেওয়া। অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে তানপুরায় সুর বাঁধতে শেখা, ঘুঙুরের রকমফের চিনতে পারার ক্ষমতা। অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে সময়। কিপটে হয়ে যাচ্ছি আমরা সময়ের হিসেব কষতে কষতে। আর অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে কতগুলি মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও তাদের শিক্ষা।

         সেরকমই একজন মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের মিশেল ছিলেন আনন্দময়ী ভট্টাচার্য, আমাদের আনুদিদা। বছরের পর বছর ধরে যার সান্নিধ্যে একটা গোটা শহর শিখেছিল সুরের সাধনার পন্থা। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমার নাচের, গানের হাতেখড়িও তাঁর হাত ধরেই। প্রথম রাগ-রাগিণীর শিক্ষা, মনিপুরী নাচের বোল, সব তাঁরই ছত্রছায়ায় শেখা। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছি তাঁর কাছে, তা বললে অসত্য বলা হবে। দুর্গাপুজোর আয়োজনে যে রবীন্দ্রনাথের গানও গাওয়া যায়, সেই সাহস অনেক ছোটবেলাতেই দিয়েছিলেন আনুদিদা। বাড়ির সবার মৃদু অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনিপুরী নাচের দিকে আমার ঝোঁক, তিনি বুঝেছিলেন। বাবা আমায় নাচের ক্লাস থেকে নিয়ে আসতে ভুলে গেলে তিনি ও মঙ্গলদিদা সযত্নে পাহারা দিতেন আমায়। নাচের পরীক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আমাদের অঞ্চলে কীভাবে কাজ করে, সেটাও ফাঁকফোকর দিয়ে শিখিয়ে দিতেন উনি। ছোটবেলায় আমাদের সদলবলে সংগীত বিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে অবাধ যাতায়াত, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দৌরাত্ম্যের পর্যায়ে চলে যেত, তা প্রশ্রয়মাখা শাসনের সাথে আগলে রাখতেন মঙ্গলাদিদা-আনুদিদার জুটি।

         আনুদিদার চরিত্রের নানা দিক নিয়ে কথা বলবেন যারা তাঁকে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে, সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন। কিন্তু আমি বলব দুটো দিনের কথা। আমরা জানি কীভাবে শিলচরের সেন্ট্রাল রোডের সেই প্রাণবন্ত বাড়িটির ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে, কীভাবে একের পর এক অকালমৃত্যুর ঝড় নাড়িয়ে দেয় সেই বাড়ির আত্মাকে। তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ২০১৭ সালের মার্চ মাস। শিলচর শহরের কানায় কানায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে সেদিন আমরা গাইছিলাম আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলার সন্তানের গান, স্মরণ করছিলাম প্রসাদকাকুকে। যে আনুদিদার কাছে শুধু ভ্রাতুষ্পুত্র নয়, ছিল তাঁর ভরসার যষ্টি, সংস্কৃতি-রাজনীতির বাহক, ধারক। যাকে মুখে না বললেও এক মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া যেত কী বলতে চাইছেন তিনি। তো এমনই আত্মজের স্মৃতিচারণের দিন তাঁকে এক ফোঁটা কাঁদতে দেখিনি। ঠায় বসেছিলেন সামনের সারির চেয়ারে, অপলক দৃষ্টিতে আমাদের গান শুনছিলেন। বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কতটুকু কালিকাপ্রসাদ আছে আমাদের মধ্যে, আর ঠিক কতটুকু গড়ে নেওয়া বাকি আছে এখনও। তাঁর ভেতরের শিক্ষক-সংগঠক বুঝে নিচ্ছিল তাঁর হাতের কাজ কতটুকু বাকি।

         আরেকদিনের কথা বলি যখন তিনি আর আগের মতো দাপিয়ে বেড়াতে পারেননা সেন্ট্রাল রোড। বিয়ের পর আমি আর দুরাই গেলাম প্রণাম করতে। জড়িয়ে ধরে আদর, প্রাণভরা আশীর্বাদশেষে হাতে তুলে দিলেন একটি গীতবিতান। আরেকটি জিনিস, যা নব্যযুগে বাঙালি অন্দরমহল থেকে অবসোলিট হতে বসেছে। কারণ হাতের মুঠোয় ফোন-ট্যাব, আর তার কাঁচে আঙুল বোলালেই রবীন্দ্রনাথ। সেই গীতবিতানের প্রথম পাতায় অবসোলিট হতে বসা কলমের কালিতে হাতের লেখায় স্নেহাশিসের বার্তা। বিয়েতে উপহার পাওয়া শাড়ি-গয়না না আনলেও ওই গীতবিতান আমি নিয়ে এসেছি আমার সাথে করে জার্মানিতে। সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছেন আনুদিদা, তা সত্য। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েননি, পড়বেন না। শিলচর শহরে আমি নিশ্চিত, আরো অনেক মানুষ সৃষ্টি করে গেছেন তিনি, যারা আবেগে বিজড়িত হওয়ার মুহূর্তেও নিজেই শিক্ষকসত্ত্বাকে হারাবেন না। আমি নিশ্চিত, আরো অনেকেই থাকবেন, যারা গীতবিতান কিনবেন, ই-বই হলেও, সেখান থেকে শিক্ষা নেবেন দিনশেষে সবকিছু অবসোলিট হয়ে যাওয়াকে রুখে দেবার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান