একলা ঘর

বাবার পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমি আর মা একটা ছোট্ট স্মরণিকা ছাপিয়েছিলাম, বাবা-বিষয়ক স্মৃতি সংকলনের মতন অনেকটা। আজ দুপুরে সেটাই পড়ছিলাম। বেশির ভাগ মানুষের স্মৃতিচারণে বাবার বিষয়ে লেখা ছাড়াও একজন ছিলেন প্রায় সব লেখাতেই উপস্থিত। তিনি আর কেউ নন। মালুগ্রামের নীল গেটওয়ালা আমাদের সেই পুরোনো বাড়ি।

শরৎকালে সেই গেটের সামনেটা শিউলি ফুলে সাদা হয়ে থাকে এখনো। এখনো বাড়ির গাছের জাম-কুল পাকলে সেই গন্ধে বাড়িছাড়া হতে হয় আমাকে। শিলচরে এখন চারদিকে আগাছার মতন বেড়ে ওঠা উঁচু বিল্ডিং। তাদের মাঝে আমাদের বাড়িটা  একটা স্টিল ছবির মতন অনেকটা। সময় থমকে গিয়েছে নীল লোহার গেটের ওপারে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি যাওয়ার বেলায় দিগন্তে রংচটা টিনের চাল বা গেটের আকাশী নীল চোখে পড়লেই বুঝতে পারি, বাড়ি ফিরেছি।

আমার ছোটবেলায় গেটটা পেরোলেই ডানদিকে ছিল সবজির বাগান, খেজুর-জামরুল-নারকেল গাছ পেরোলেই। আমার, পাম্মুর, পিসির এবং প্রতাপকাকুর (আমাদের বাড়ির মুশকিল আসান) তত্ত্বাবধানে সেই বাগানে কাঁচালঙ্কা, সর্ষেশাক, বেগুন, টমেটো আরো কত কী অদ্ভুত গাছে ছেয়ে থাকত বাগানটা। পেছনের উঠোনে আমার হাতে লাগানো লিচুগাছ, যেখানে ফল হতে কোনদিনই দেখিনি, বুঝিয়ে দেয় মাতৃত্ববিষয়ে আমার কত প্রতিভা! এছাড়া চারদিকে অজস্র ফল-ফুলের গাছ তো রয়েছেই।

আমার কাছে আমাদের বাড়ির মূল আকর্ষণ কিন্ত গাছ-গাছালিতে নয়। নীল গেট পেরিয়ে, হাতের ডানে বাবার ভাঙা সবুজ স্কুটার পেরোলেই যে বিশাল বসার ঘর, সেটাই এই বাড়ির আসল চুম্বক। ঠিক যেভাবে বাবার সবুজ স্কুটারে চড়েনি এমন মানুষ শিলচরে এবং খানিকটা সিলেটেরও সংস্কৃতি অঙ্গনে পাওয়া বিরল, সেভাবেই আমাদের বসার ঘরের অগুনতি আড্ডাগুলির অংশ হননি এমন লোকও প্রায় নেই বললেই চলে। এই ঘরে যেমন সকালে আপনি পাবেন যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা বিরাট মাপের সমস্ত চায়ের কাপ, রাত এগারোটার পর আপনি নিঃসন্দেহে কানের পাশে শুনতে পাবেন বাবার সুদৃঢ় নাসিকাগর্জন। আমার এই ঘরের সাথে অনেকরকম স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, এবং তাই সত্য। ছোটবেলায় দরজার কাঁচের এপার থেকে স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষা বা অন্য দিদিদের সাথে বাবার কাছে “বসে আছি হে কবে শুনিব তোমার বাণী” বা “আমার মনের মাঝে যে গান বাজে” শেখা, আবার হয়তো অনেক রাতে বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষারত মায়ের পাশে ঘুমে ঢুলঢুলু আমি- সব এই ঘরেই। খুব মনে পড়ছে আমাদের বাড়িতে আয়োজিত গণনাট্যের সবাই মিলে একটা গানের আসরের কথা। মাটিতে সবাই গোল হয়ে বসা, একের পর এক গান হচ্ছে। বাবা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। আমি পাশে বসা। মা রান্নাঘরে, মাঝে মাঝে এসে গেয়েও যাচ্ছে দু-এক লাইন টুক করে। এখন যখনই খুব আনন্দের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করি, এইদিনটা কেন জানিনা স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসমান হয়ে ওঠে।

বসার ঘরের আসরগুলিতে কয়েকজন মানুষ দেখতাম বেশির ভাগ সময়েই স্থায়ী। যেমন গোরাকাকু বা জয়-মিঠু-প্রসাদকাকুরা বা বাবার ‘শংকরী’ হোটেলের আড্ডার পুরো পল্টন। সময়ের সাথে সাথে মাঝে মাঝেই যোগ দিত সিলেটের বাবু-টুকু-লিটন কাকুরাও। এখন শিলচর গেলে যেমন পাই কিষাণ কাকু, রাজীবকাকু বা সন্তোষজেঠুদের। সময়ের সাথে অনেক কিছু পাল্টালেও সমস্ত আসরে বাবার চেয়ারে কাত হয়ে ঘুমোনো এবং ঘুম আসার আগে থেকেই আশ্চর্যভাবে নাক ডাকতে শুরু করাটা একটুও পাল্টায়নি। আগে আমি রাহুলজেঠু বা প্রসাদকাকুদের কোলে বসে সময় কাটাতাম। এখন ডোডো আমার ভাগের আহ্লাদীগুলো করে নেয়। মা একই ভাবে রান্নাঘর আর বসার ঘরে মাল্টিটাস্ক করে যায়। পিসিকেও দেখা যায় ইনসুলিন সিরিঞ্জ হাতে ঘোরাফেরা করতে করতে আড্ডায় টীকাযোগ করতে।

ভাব-ভালোবাসা, ঠাট্টা-ঝগড়া অনেককিছুরই নিঃশব্দ সাক্ষী আমাদের বসার ঘর। এখন প্রতিবার বাড়ি গেলে আগের সেই ঔজ্জ্বল্য খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। বাড়ির দেওয়ালের চটে যাওয়া রঙের মতন অনেক মানুষই আজ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই আসর থেকে খসে পড়েছেন। অবহেলায়, খানিক অযত্নে প্রপিতামহের পোর্ট্রেটের পাশ থেকে ঝুল উঁকি দেয়। আঁতুড়ে থাকাকালীন আমার ঠাকুর্দার মা একটা বিশাল কাঁথা সেলাই করেছিলেন। দরজা দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে ওপরে তাকালেই সেটা দেখতে পাওয়া যায়। আজকাল ওটার দিকে তাকালে সেটাও কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে ঠেকে।

এই ঘরের প্রতিটা ইটে কান পাতলে এখনও অনেক গল্প শুনতে পাই। দেওয়ালের প্রতিটা আঁচড় দুম করে কোন স্মৃতি উস্কে দিয়ে চলে যায়। আজো একই রকম বৃষ্টি পড়লে টিনের চালের আওয়াজ শুনতে শুনতে অভ্যাসবশে চোখ চলে যায় ঘরের ছাদে বাঁশের ছাউনিতে থাকা একটা ফুটোয়। কারণ ছোটবেলায় বৃষ্টি পড়লেই ওটা দিয়ে ঘরে জল পড়ত। এখন আর পড়ে না। ওটা সারানো হয়ে গেছে। ফুটোটা যদিও বিরাজমান।

ঘরটাও এখনও একই রকম রয়ে গেছে।

সত্যিই ওখানে আর কোনো বৃষ্টিরই জল পড়ে না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান