কাছাড় থেকে কন্যাকুমারীঃ পর্ব ২

(প্রথম কিস্তির পর)

৩ ডিসেম্বর কলকাতায় পৌঁছেই দেখি বাড়ির গেট সাজানোর কাজ সম্পূর্ণ। মায়ের সুনিপুণ পরিকল্পনায় বিয়েবাড়ির সাজ সম্পূর্ণ হয়েছে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির। সেই রাতে কোনোমতে ঘুম সেরেই পরদিন সকালে আমি ছুটলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। জার্মানি থেকে দুরাইয়ের বন্ধু-বান্ধব আসছে। তাদের আনতে যেতে আমিই ভরসা। ওই যে ভাষার গেরো! জার্মান বন্ধু নিনাকে আমি রিসিভ করলাম, দুরাই রিসিভ করলো জার্মান-জর্জিয়ান জুটি মার্কুস-মায়াকে। আমার দুই ভাই টাট্টু, লাটুশ আর বোন টুপুর রিসিভ করলো দুরাইয়ের দুই চীনা বান্ধবীকে। সবার থাকার ব্যবস্থা হলো দুরাইয়ের বাড়ির সাথেই লাগোয়া গেস্ট হাউসে। এদিকে ততক্ষণে কলকাতায় এসে পৌঁছে গেছে ‘টিম তামিলনাড়ু’। দুরাইয়ের দুই ভাই, আরেক বন্ধু-বন্ধুপত্নী সবাই। বরের বাড়ির পাশের গেস্ট হাউসেই ‘বরযাত্রী’।

DSC_8258

প্রথম অনুষ্ঠান আমাদের বাড়িতে ৪ ডিসেম্বর সিলেটী রীতি মেনে ‘পানখিলি’। মূলত পান, সুপুরি ও নানা রকমের মশলা দিয়ে বানানো হয়ে অনেকগুলি পানের খিলি। পরিবারের সব নারীরা একসাথে মিলে সেই খিলি সাজান। বিশেষ করে দুটি খিলি সাজানো হয় পানের ডালায়। সেই দুই বিশেষ খিলির গায়ে থাকে একটি রূপোর ও আরেকটি সোনার কাঠি। তারপর এই সাজানো ডালা নিয়ে সব নারীরা কনের মায়ের নেতৃত্বে দল বেঁধে পাশের কোনো আরাধ্য মন্দিরে গিয়ে পছন্দের দেবদেবীকে নেমন্তন্ন করে আসেন বিয়ের অনুষ্ঠানে সামিল হতে। এটাই পানিখিলি।

কিন্তু আমার পানখিলিতে পরিবারের নারীদের পাশাপাশি পান সাজানোতে অংশগ্রহণ করে নিনা, মায়া, আইজেল থেকে শুরু করে আমার তামিল পরিবারের নারীরাও। আমার শ্বাশুড়ি তো মন্দির পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন একমাত্র ছেলের বিয়েতে ঠাকুরকে নেমন্তন্ন করতে। যাই হোক, পান সাজানোর পর পেটপুরে খাওয়া দাওয়া, এতেই ছিল আমার বেশি আকর্ষণ। দুরাই বেচারা নতুন জামাই হওয়া সত্ত্বেও কনেবাড়ির কর্তার ভূমিকাও মাঝে মাঝে পালন করছিল। আর আমার ছোট ভাইবোনেদের সে কী সাজ! আর শুধু ভাইবোন কেন? আমার মা-মাসি-পিসি-মামী-কাকী-জেঠী-দিদা কেউই কম যান না। সবারই এক একদিন এক এক রকমের সাজ। শুধু আমিই পানখিলির দিন সাজতে গিয়ে দেখি এই দিনের জন্য কোনো আলাদা লালপেড়ে সাদা শাড়িই কেনা হয়নি। ভাগ্যিস বন্ধু প্রিয়ঙ্করের মা একটা খুব সুন্দর সাদা-লাল জামদানি দিয়েছিল, ওই দিয়েই সে যাত্রা পার হল।

৪ এর পর ৫ ডিসেম্বর। আমাদের গায়ে হলুদ বা অধিবাস। ‘আমাদের’ বলছি, কারণ আমার বাড়িতেই আমার আর দুরাইয়ের গায়ে হলুদ একসাথে আয়োজন করা হয়। হলুদের দিন সকাল থেকেই বাড়ি সরগরম। শিলচর থেকে কিষাণকাকু, টিন্টুকাকু এসে গেছে ফিল্ডে। ডিমাপুর থেকে বিষ্ণুকাকু, বাবলাকাকু, শুভ্রাকাকী, অভিজিতজেঠুও। বাংলাদেশ থেকে সপরিবারে শেরোকাকু, বাবুকাকু, টিপুকাকু, টুকুকাকু। আর আমার জেঠু, পিসি, মৌপিসি আর সঙ্গীতাদি তো আগে থেকে ছিলই। একদিনের জন্য কলকাতায় এসে গেল শিলচর থেকে নাড়ুকাকু, মুন্নিকাকীমণি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নন্দনদাদা, বড়জেঠু ও তার বেলজিয়ান স্ত্রী সারাজেঠি, মান্তুজেঠু, নীলকাকু এসে গেলো। আমার যত ভালোবাসার লোক সব একসাথে! এ যেন আমার কাছে স্বপ্নপূরণের মতো। আসলে আমার এটাই ইচ্ছে ছিল, পরিবার বলতে যে যে মানুষকে বুঝি, তারা সবাই একসাথে আনন্দ করতে করতে আমাকে আর দুরাইকে বরণ করবে, এটাই চেয়েছিলাম। আর হলোও তাই। আর তাদের পরিচালনায় সকাল সকাল বাড়ির গ্যারাজে শুরু হলো আলপনা দেবার পালা।

78348350_10157519887994303_8990537268418576384_n

টিম সিলেটের সৌজন্যে আমার সব চাচা আর ভাই-বোনেরা মিলে চলল সারা সকাল আলপনা দেওয়া। তারপর দুপুরে সবাই মিলে বাড়িতে পেটপুরে খাওয়া। এদিকে সিলেটির সাথে তামিলের বিয়ে যখন, তখন ধামাইল না হলে কি আর হয়? সিলেটী মানসম্মানের প্রশ্ন এটা। আর ওদিকে তামিলপক্ষেরও সম্মানরক্ষার প্রশ্ন। তারাও শুনলাম সকাল থেকে নাচের মহড়া দিয়েছে। তাদের সামনেও চ্যালেঞ্জ সিলেটি ধরাশায়ী করতে সচেষ্ট। কিন্তু ঘরশত্রু বিভীষণ হয়ে আমারই বোন তিতির চলে গেল তাদের নাচে সাহায্য করতে। জামাইবাবু-প্রীতির এমনই জোর। যাই হোক, সন্ধ্যে হতেই দুরাই তার বরযাত্রী নিয়ে এসে উপস্থিত সমবেত গায়ে হলুদের জন্য। আগে গায়ে হলুদ, গয়না পরানো, তারপর নাচাগানা খাওয়া দাওয়া। এদিকে গায়ে হলুদ তো হবে, কিন্তু জামাই বেচারা তো ধুতি পরতেই জানেনা। অগত্যা শ্বশুরের হাতেই পড়লো দায়িত্ব জামাইকে ধুতি পরানোর। সেকি হাস্যকর পরিস্থিতি!

আর আমি? চারদিকে চেয়ে দেখি মাসি-মেসো-মামা-মামী-কাকা-কাকী-জেঠু-জেঠি-পিসি-দিদা-দাদু-ভাই-বোন-বাবা-মা সবাই রংমেলন্তী করে অসাধারণ সাজ দিয়েছে। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি। ডোডো পর্যন্ত বেলায় বেলায় ড্রেস চেঞ্জ! মুখে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। যাইহোক, আমি খুবী সাদামাটা একটা হলুদ শাড়ি পরে ধুতি-পরিহিত দুরাইকে নিয়ে নিচে নামলাম। আলপনা আঁকা মাটির ওপর আলপনা আঁকা পিঁড়িতে বসলাম দুজন। আমাদের সামনে মাদুর বিছিয়ে, চেয়ারে, দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০-১২০ জন লোক। সবাইই পরিবার। আর পেছনে কলকাতার বিখ্যাত সিলেটি গানের দল ‘সুরমা পিয়াসী’ একের পর এক ধামাইল গান আর সিলেটি বিয়ের গান গেয়ে আসর জমাচ্ছেন। আমার নিজেরই আর তর সয় না। কখন উঠে নাচব, সেই চিন্তা ঘুরছে মাথায়। আর ভিড়ে চিঁড়েচ্যাপটা হয়েই প্রাণপণে ছবি তোলার চেষ্টায় জর্জরিত বেচারা অশোকদা, যার তোলা ছবিগুলি কথা বলে। এবারে শুরু হলো দলবেঁধে আমাদের হলুদ করে তোলা। যে যেমন পারছে আমাকে আর দুরাইকে হলুদ মাখিয়ে ভূত বানাচ্ছে। আর শুধু আমাদের না, এই সুযোগে আমার শ্বশুর, আমার বাবা, ভাইসহ যে যাকে পারছে হলুদ মাখাচ্ছে। আমার মা তো অর্ধেক হলুদ দুরাইয়ের দাড়িভর্তি গালেই লেপে দিল। বেচারা দুরাইয়ের সে কি করুণ অবস্থা! সিলেটি, ঢাকাইয়া, জার্মান, তামিল, জর্জিয়ান, চীনা থেকে বেলজিয়ান সবাই এই চান্সে হলুদ মাখছে ও মাখাচ্ছে। আর শুধু কী হলুদ? তিতিরের বুদ্ধিতে সেদিন বাড়িতে ডাকা হয়েছিল এক মেহেন্দিওয়ালাকে। এক কোণায় বসে সারা সন্ধ্যে একের পর এক হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে চলেছিল সে ধৈর্য সহকারে। প্রায় একঘণ্টা টানা হলুদ মেখে শান্ত হবার পর এলো গয়না পরানোর পালা। আমি আর দুরাই শাড়ি-পাঞ্জাবী বদলে আবার এসে বসলাম।

_DSC5780

যে যা গয়না দিয়ে বরণ করবেন আমাদের, তারা একে একে এসে সব গয়না পরিয়ে দিতে লাগলেন আমাদের। এখানে একটা কথা বলি, আমি নিজে বিয়ে বা এই ধরনের উদ্যোগে সোনা কিনে পয়সা নষ্ট করার ঘোর বিরোধী। আমি বিয়ের আগেই স্পষ্ট বলেছিলাম, একটাও নতুন গয়না বানাবো না, কিনব না। তার চেয়ে সেই পয়সা বন্ধুবান্ধবকে অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে, গানবাজনার পেছনে খরচ হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু অহেতুক দাম দিয়ে সোনা বা কোনো শাড়ি বা গয়না কেনার পক্ষপাতী আমি নই। তামিল বিয়েতে ভাড়া করা নকল সোনা পরেছিলাম। আর এরপরের সব অনুষ্ঠানেই যা পরেছি তা পরিবারসূত্রে পাওয়া। একমাত্র আমি আর দুরাই দুজন দুজনকে আংটি পরিয়েছিলাম, যা নিজেরাই কিনেছিলাম। আর এছাড়া আমার তামিল মঙ্গলসূত্র বা তালির সোনাও পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। আমার বাবা-মাও অহেতুক সোনার বিরোধী। কিন্তু তারপরেও আমার বৃহত্তর পরিবার থেকে একটু একটু করে পাওয়া সব গয়না পড়তে পড়তেই হাঁপিয়ে উঠলাম। মা, দিদি, পিসি, মাসি, দিদা, মামী, কাকীরা কোন ছাড়! জার্মান বন্ধু ডেনিসের মা আইজেলও হাতে করে গয়না নিয়ে এসেছিল আমার জন্য! কিষাণকাকুর মা শিলচর থেকে পাঠালেন কানের দুল। সঙ্গীতাদি নিজের বিয়েতে পাওয়া গয়না আমায় পরিয়ে দিল। আর দুরাই? ও তো আদরের জামাই। শুধু কি গয়না? খোদ সিলেট-টিম নিয়ে এসেছিল ওর জন্য স্যুট! ওদিকে আর কত কী! মানুষ শুনি বিয়েতে টাকার হিসেব করে, আমাদের তো গোটা বিয়েটাই গেল হইহুল্লোড় আর মানুষের ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে। মাঝে মাঝে আমি আর দুরাই প্রায়ই ভাবি, সত্যিই কি এত ভালোবাসার যোগ্য আমরা? ওহ আর অন্যান্য তামিল বিবাহিত মেয়েদের মতো আমিও সেইদিন থেকেই দুপায়ের দুআঙুলে রূপোর আংটি পরি। সেটা বহু কসরত করবার পর দুরাই সাফল্য সহকারে আমায় সেদিন পরিয়েছিল।

যাইহোক, গয়নার কথা বাদ। এখন আসি হুল্লোড়ের কোথায়। গয়না-টয়না পরে আমি ভালো বউয়ের মতো বসে থাকব, আশা করছিলেন কি? না! পিঁড়িতে আমাদের বসিয়ে আমাদের ঘিরে গোল করে ধামাইল নাচা শুরু করল একে একে সবাই। শুরু করলো অবশ্যই আমার মা। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে থেকেই মা কেন জানি সেদিন সারা সন্ধ্যে সুযোগ পেলেই টুক করে একা একা নেচে নিচ্ছিল। ধামাইলেও তাই হল। আমার মাসিদের সুযোগ দেবার আগেই মা শুরু করে দিল নাচ। তারপর একে একে সবাই যোগ দিলেন, ভীড় বাড়ল, আর আমার হাত-পা নিশপিশ করতে লাগল। শেষে এক পর্যায়ে আর থাকতে না পেরে কোমরে আঁচল বেঁধে নেমে পড়লাম নিজেই নিজের বিয়ের খুশিতে ধামাইল দিতে। উফ সে কি মজা!

_DSC5865

কিন্তু তারপরই এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। একদিনের মহড়ায় অসাধারণ নৃত্য পরিবেশনা করলো প্রথমে আমাদের বিদেশিনীরা, আর তারপর তামিল গানের সাথে বরপক্ষের ছেলেরা। সেদিন দুরাইয়ের নাচ না দেখলে আমার কোনদিন জানা হতোই না যে নাচ তালছাড়া করা যায়, কীর্তনের মতো মুক্তছন্দ! তালের প্রতি সম্পূর্ণ দায়-অনাবদ্ধ! আহা!

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের দিন আমাদের গ্যারেজে তিলধারণের জায়গা ছিলনা। আসলে আমাদের পরিসর ছিল ছোট, কিন্তু আত্মীয়তার গণ্ডি একটু বেশিই বিস্তৃত হবার ফলে সবাই ঠিকই মানিয়ে নিয়েছেন। এতটাই আমাদের অক্ষমতা ছিল যে বাড়ির ভেতর সবাইকে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানোর মতো জায়গাটুকুও ছিল না। হাতে হাতে থালা নিয়ে, চেয়ার টেনে বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে খেয়েছে আমাদের বন্ধুরা, ‘অতিথিরা’। তাও যাকেই জিজ্ঞেস করি আমাদের বিয়ের সবচেয়ে আনন্দঘন দিন কোনটা ছিল তাদের কাছে, সবাই শুধু গায়ে হলুদের সন্ধ্যের কথাই বলে।

আর আমার কাছে? আমার কাছে এইদিনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত হচ্ছে দুটি। প্রথম, আমার এই বিশাল ব্যপ্ত পরিবারের সকল সদস্যকে কাছে পাওয়া। তাদের চোখে আমাদের জন্য স্নেহ দেখতে পাওয়াটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আর দ্বিতীয় প্রিয় মুহূর্ত? যখন মামাতো ভাই লাটুশ ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখায় যে ওপরে সোফায় বসে  তুর্কিশভাষী ইউসুফ আর বাংলাভাষী মেসোর মধ্যে গুগল ট্রান্সলেটের ভরসায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলছে কথোপকথন। আমি জানিনা আর অন্য কোনো পরিসরে এই দৃশ্য আমার দেখার সৌভাগ্য হতো কি না। জানেন, আইজেল যখন আমার মা-পিসি-দিদাকে দেখে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার আর দুরাইয়ের মাথায় ধানদুব্বো ছোঁয়ায়, তখন সেই ধানের সামনে মাথানত করতে আমার ভেতরের আবিশ্বাসী সত্ত্বা একটুও কাঁপে না? কারণ ওই ধানে লেগে আছে এই অবিভক্ত পৃথিবীর সব মায়েদের আশীর্বাদ, কল্যাণকামনা। ওতে কোনো বিভেদ নেই, বারণ নেই। বিশ্বাসী মুসলমানের হাতে আঁকা আলপনার ওপর পিঁড়িতে বসি আমরা, আর সেই মাটির ওপরেই যখন সবাই ধামাইলের তালে নাচেন, তখন সেই আলপনায় আমি হারাম খুঁজি না। কারণ হইহই করে তখন প্রতিধ্বনিত হয় চিরন্তন বাংলার সবুজ, প্রাণ। ওখানেও কোনো বারণ নেই, ফতোয়া নেই।

আমাদের এই অভিনব গায়ে হলুদের গল্প এতটুকুই। কারণ, পরের দিনের পর্বে অপেক্ষা করে আছে সাজানো কুঞ্জ, গরম রসগোল্লা আর ভুলে যাওয়া সিঁদুরের কাহিনী। তাই আজ আপাতত এটুকুই।

(চলবে)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান